পালস অক্সিমিটার

পালস অক্সিমিটার কীভাবে কাজ করে?

শেয়ার করুন

পালস অক্সিমিটার

পালস অক্সিমিটার: বেঁচে থাকার জন্য আমাদের অক্সিজেনের দরকার হয়। সুস্থ শরীর বাতাস থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারে, এবং সেই অক্সিজেন রক্তের মাধ্যমে শরীরের প্রত্যেকটি কোষে পাঠায়।

শরীরে অক্সিজেন কেন দরকার হয়? অক্সিজেনের সরবরাহ না থাকলে, বা প্রয়োজনের চেয়ে কমে গেলে আমাদের কী অসুবিধা হয়? আমাদের শরীরের জীববৈজ্ঞানিক মৌলিক উপাদান হলো—কোষ। আমাদের শরীরের সবকিছু এই কোষ দ্বারা গঠিত। আমাদের শরীরে গড়ে প্রায় ৭৫ ট্রিলিয়ন বা ৭৫ লক্ষ কোটি কোষ আছে। এক ফোঁটা রক্তেই আছে প্রায় ৫০ লক্ষ লাল রক্ত কোষ।

সামগ্রিকভাবে বলা চলে আমাদের শরীরের সমস্ত কাজ নিয়ন্ত্রিত হয় এই কোষগুলির সমন্বিত কার্যক্রমের মাধ্যমে। শরীরের প্রত্যেকটি কোষ সক্রিয় থাকার জন্য যে শক্তি লাগে তা নিজেরাই তৈরি করে। কোষ সক্রিয় থাকার অর্থ হলো শরীরে তার যে ভূমিকা তা সঠিকভাবে পালন করা এবং

নির্দিষ্ট সময় পর পর কোষ বিভাজনের মাধ্যমে নতুন কোষ তৈরি করা। নতুন কোষ তৈরি হতে না পারলে আমরা দ্রুত মারা যাবো—কারণ স্বাভাবিক অবস্থায় প্রতিদিন প্রায় ৭০ হাজার কোটি কোষের মৃত্যু হয় আমাদের শরীরে। নতুন কোষ এই মৃতকোষগুলির দায়িত্ব পালন করে।

আরও পড়ুন:

সুগার রোগীর খাদ্য তালিকা

কোষের কাজ চলার জন্য যে শক্তি লাগে সেই শক্তি উৎপন্ন হবার জন্য দরকার হয় অক্সিজেনের। বেশ কয়েকটি ধাপে এই শক্তি উৎপাদন প্রক্রিয়া সংঘটিত হয়। আমরা যে খাবার খাই, সেগুলোর রাসায়নিক উপাদানের সাথে অক্সিজেনের বিক্রিয়ায় শক্তি উৎপন্ন হয়। যেমন গ্লুকোজ অণুর সাথে অক্সিজেন অণুর বিক্রিয়ার ফলে যে তাপ উৎপন্ন হয়, সেটাই কোষের কাজকর্ম করার শক্তি যোগায়। তার সাথে তৈরি হয় পানি এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইড। এই পানিও শরীরের অনেক কাজে লাগে। আর কার্বন-ডাই-অক্সাইড আমরা শরীর থেকে বের করে দিই।

পালস অক্সিমিটার : ফাইল ছবি

অক্সিজেন লেভেল কত হলে বিপদজনক

একজন সুস্থ ব্যক্তির রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা থাকা উচিৎ ৯০ থেকে ১০০ শতাংশ। অক্সিজেন ৯০ এর নিচে নেমে গেলেই সমস্যা শুরু হয়

কোষ তার দরকারি অক্সিজেন পায় রক্ত থেকে। আমাদের শরীরের রক্তসংবহনতন্ত্রে দুই ধরনের রক্তনালিকা আছে। এক ধরনের রক্তনালিকা অক্সিজেনযুক্ত রক্ত সরবরাহ করে—তাদেরকে আমরা বলি ধমনী বা আর্টারি। আরেক ধরনের রক্তনালিকা কার্বন-ডাই-অক্সাইডযুক্ত রক্ত বহন করে—তাদেরকে আমরা বলি শিরা বা ভেইন। ধমনী কোষের মধ্যে অক্সিজেন পৌঁছে দেয়। আর কোষে যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড তৈরি হয় শিরা সেগুলো নিয়ে আসে ফুসফুসে। ফুসফুস রক্ত থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড আলাদা করে ফেলে। আমরা নিশ্বাসের মাধ্যমে সেই কার্বন-ডাই-অক্সাইড শরীর থেকে বের করে দিই।

সুস্থ থাকার জন্য আমাদের রক্তে প্রয়োজনীয় পরিমাণে অক্সিজেন থাকতে হয়। রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ মাপা হয় ধমনীর রক্ত পরীক্ষা করে। আর্টারিয়াল ব্লাড গ্যাস বা এবিজি পরীক্ষার মাধ্যমে সঠিকভাবে মাপা যায় রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ। কিন্তু সেই পদ্ধতিটি খুব সহজ নয়। ধমনী থেকে রক্ত নিয়ে তা পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করতে হয়।

এর চেয়ে অনেক সহজ পদ্ধতি হলো খুবই ছোট্ট একটা যন্ত্র—পালস অক্সিমিটারের সাহায্যে রক্তের অক্সিজেনের পরিমাণ মেপে দেখা। এই যন্ত্রটি আঙুলে লাগিয়ে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ এবং হার্টবিট মাপা যায়। এর জন্য শরীর থেকে রক্ত নেয়ারও দরকার হয় না, কোনো পরীক্ষাগারেরও দরকার হয় না। বিদ্যুৎচুম্বক তরঙ্গের সাধারণ ধর্মকে কাজে লাগিয়ে রক্তে অক্সিজেন সম্পৃক্তি বা ব্লাড অক্সিজেন স্যাচুরেশান পরিমাপ করা হয়। জাপানী ইঞ্জিনিয়ার তাকুও আওইয়েগি (Takuo Aoyagi) ১৯৭৪ সালে আধুনিক পালস অক্সিমিটার (pulse oximeter) উদ্ভাবন করেন।

আরও পড়ুন:

ডায়াবেটিসের লক্ষণ ও প্রতিকার

পালস অক্সিমিটার খুব সহজেই এই সম্পৃক্ততার পরিমাণ হিসেব করতে পারে। কীভাবে? পালস অক্সিমিটার একটি ছোট্ট ক্লিপের মতো আঙ্গুলের উপর আটকে দেয়া যায়। এর একদিকে থাকে পাশাপাশি দুটো লাইট এমিটিং ডায়োড বা এলইডি লাইট সোর্স। এদের একটি লাল আলো দেয়—যার তরঙ্গ দৈর্ঘ্য প্রায় ৬৬০ ন্যানোমিটার।

এই আলো আমরা খালি চোখেও দেখতে পাই। অন্য এলইডি থেকে ইনফ্রা-রেড বা অবলোহিত আলো নির্গত হয়—যার তরঙ্গ দৈর্ঘ্য প্রায় ৯৪০ ন্যানোমিটার। অবলোহিত আলো আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না। এই আলো ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ বা বিদ্যুৎচুম্বক তরঙ্গের অংশ। ক্লিপের অন্যপ্রান্তে থাকে আলোক-সংবেদী ডিটেক্টর যা বিদ্যুৎচুম্বক তরঙ্গের সাথে মিথস্ক্রিয়ায় (ইন্টারঅ্যাকশান) তড়িৎচুম্বক তরঙ্গের সমানুপাতিক হারে ইলেকট্রনিক সিগনাল উৎপন্ন করে।

বিদ্যুৎচুম্বক তরঙ্গ প্রয়োগ করলে তার কিছুটা শরীরে শোষিত হয়, আবার কিছুটা শরীর ভেদ করে অন্যদিক থেকে বের হয়ে আসে। কতটুকু শোষিত হবে, কতটুকু নির্গত হবে তা নির্ভর করে বিদ্যুৎচুম্বক তরঙ্গের কম্পাঙ্ক এবং শক্তির উপর। দৃশ্যমান আলোর শক্তির চেয়ে এক্স-রের শক্তি বেশি। তাই এক্স-রের বেশিরভাগ শরীর ভেদ করে বের হয়ে আসে।

কিন্তু দৃশ্যমান আলোর বেশিরভাগ শোষিত হয়। আবার একই শক্তি ও কম্পাঙ্কের তরঙ্গও শরীরের কোন কোষ কতটুকু শোষণ করবে তা নির্ভর করে কী পরিমাণ পদার্থ এবং কোন ধরনের পদার্থের ভেতর দিয়ে তা আসছে তার ওপর। অক্সিজেনযুক্ত হিমোগ্লোবিনে পদার্থের পরিমাণ অক্সিজেনমুক্ত হিমোগ্লোবিনের চেয়ে বেশি।

তাই অক্সিজেনযুক্ত হিমোগ্লোবিন অক্সিজেনমুক্ত হিমোগ্লোবিনের চেয়ে অনেক বেশি আলো শোষণ করে। অক্সিজেনযুক্ত হিমোগ্লোবিন লাল আলো যতটুকু শোষণ করে তার চেয়ে অনেক বেশি শোষণ করে অবলোহিত আলো।

অক্সিজেনমুক্ত হিমোগ্লোবিনের শোষণ হয় উভয়ক্ষেত্রেই আনুপাতিকহারে কম।

অক্সিমিটারের ক্লিপ আঙুল চেপে ধরে। আঙ্গুলের মধ্যে শিরা এবং ধমনী দুটোই আছে। ধমনীর রক্তে অক্সিজেন থাকে। কিন্তু শিরার রক্তে যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড থাকে, সেই কার্বন-ডাই-অক্সাইডেও অক্সিজেন থাকে। তাহলে সেই অক্সিজেনও হিসেবে চলে আসার কথা। তাহলে শিরার রক্ত এবং ধমনীর রক্ত কীভাবে বুঝতে পারে অক্সিমিটার?

শুধুমাত্র ধমনীর রক্তের অক্সিজেনই তো আমরা মাপতে চাই। এখানে ভূমিকা রাখে আমাদের হৃদপিণ্ডের সংকোচন এবং প্রসারণ বা সিস্টোল এবং ডায়াস্টোল। হৃদপিণ্ডের সংকোচনের সময় ধমনীর রক্তের পরিমাণ বেড়ে যায়, আবার প্রসারণের সময় ধমনীর রক্তের পরিমাণ কমে যায়। ফলে ধমনীতে রক্তের পরিমাণের উঠানামার তরঙ্গ তৈরি হয়। এই তরঙ্গের কম্পাঙ্ক ধমনীর পালস বা স্পন্দনের কম্পাঙ্কের সমান। 

আরও পড়ুন:

রোগ থেকে মুক্তির দোয়া

ধমনীর রক্তে অক্সিজেন সম্পৃক্ততার পরিমাপ করা হয় অক্সিজেনযুক্ত ও অক্সিজেনমুক্ত হিমোগ্লোবিনের অনুপাতের হিসেব করে। রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ বেশি হলে লাল আলোর শোষণ বেশি হবে, নির্গমন কম হবে। ফলে ডিটেক্টর কম আলো শনাক্ত করবে। অবলোহিত আলোর শোষণ ঘটবে আরও বেশি। ডিটেক্টর অবলোহিত আলো শনাক্ত করবে আরও কম।

তখন লাল আলো ও অবলোহিত আলোর অনুপাত হবে বেশ কম। একইভাবে রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ কম হলে শোষণ কম হবে, নির্গমন বেশি হবে। ফলে ডিটেক্টরে শনাক্তকৃত লাল আলো ও অবলোহিত আলোর অনুপাত হবে বেশ বড়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে ডিটেক্টরে শনাক্তকৃত লাল ও অবলোহিত আলোর অনুপাত অক্সিজেন সম্পৃক্ততার বিপরীত অনুপাতিক।

অক্সিমিটারের ক্লিপে লাল ও অবলোহিত আলোর এলইডি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু ব্যবহারের সময় রুমে অন্য যেসব আলো থাকে—সেই আলোও আঙুলে প্রবেশ করে। এখন সেই আলো কি অক্সিমিটারের রিডিংয়ে সমস্যা করে? আসলে করে না। কীভাবে? অক্সিমিটারের ক্লিপে আঙুল রাখার পর প্রথম ধাপে লাল আলো জ্বলে।

তখন রুমের আলো ও লাল আলো ডিটেক্ট করে ডিটেক্টর। তারপর দ্বিতীয় ধাপে অবলোহিত আলো জ্বলে। তখন ডিটেক্টর অবলোহিত আলো ও রুমের আলো ডিটেক্ট করে। তৃতীয় ধাপে লাল ও অবলোহিত আলো দুটোই বন্ধ থাকে। তখন শুধু রুমের আলো ডিটেক্ট করে ডিটেক্টর। অক্সিমিটারের ইলেকট্রনিক সার্কিট এই রুমের আলোর সিগনাল আনুপাতিক হিসাব থেকে বাদ দেয়।

তাই রুমে কী আলো জ্বললো তাতে অক্সিমিটারের রিডিং-এ কোন সমস্যা হয় না। তবে আঙুলের নখে যদি গাঢ় রঙের নখপালিশ থাকে—অক্সিমিটারের রিডিং-এ সামান্য তারতম্য ঘটতে পারে। এই করোনাকালে অনেকেই শরীরে অক্সিজেন সম্পৃক্তির পরিমাণের দিকে নজর রাখছেন পালস অক্সিমিটারের সাহায্যে। সাধারণত সুস্থ শরীরে রক্তের অক্সিজেন সম্পৃক্ততা ৯৫%-এর বেশি থাকে।

পালস অক্সিমিটার ব্যবহারের নিয়ম

যখন পালস অক্সিমিটার রিডিংয়ের জন্য আঙুল বেছে নেওয়ার কথা আসে, তখন সাধারণ সম্মতি হল যে মধ্যমা আঙুল বা তর্জনী সবচেয়ে সঠিক ফলাফল প্রদান করে থাকে। এই আঙ্গুলগুলি সাধারণত তাদের পর্যাপ্ত রক্ত ​​​​প্রবাহ এবং আঙ্গুলের ডগায় ত্বকের পুরুত্বের কারণে পছন্দ করা হয়ে থাকে।

পালস অক্সিমিটারটি সঠিকভাবে স্থাপন করুন: পালস অক্সিমিটারটি পায়ের আঙুলের উপরে স্থাপন করা উচিত, ঠিক যেমন এটি একটি আঙুলের উপর যেন থাকে । নিশ্চিত করুন যে এটি স্নুগ কিন্তু খুব টাইট নয় এবং সেন্সরটি আপনার পেরেকের বিছানার সাথে সারিবদ্ধ রয়েছে।

পালস অক্সিমেট্রি হল একটি পরীক্ষা যা রক্তের অক্সিজেন স্তর (অক্সিজেন স্যাচুরেশন) পরিমাপ করতে ব্যবহৃত হয়। এটি একটি সহজ, ব্যথাহীন পরিমাপ যা আপনার শরীরের অংশে অক্সিজেন কতটা ভালোভাবে আপনার হৃদয় থেকে দূরে, যেমন বাহু এবং পায়ে পাঠানো হচ্ছে।

এতক্ষন আমাদের সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *