স্বপ্নের পদ্মা সেতু
সূচনাঃ
স্বপ্নের পদ্মা সেতু রচনা:- বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। দক্ষিণ এশিয়ার দীর্ঘতম দুটি নদী- ব্ৰহ্মপুত্র ও গঙ্গা যেখানে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে সেখানেই কালের পরিক্রমায় গড়ে উঠেছে পৃথিবীর বৃহত্তম এই ব-দ্বীপ। ভৌগােলিক গঠনগত কারণেই এদেশে জালের মতাে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য নদ-নদী। কিছু কিছু নদী আছে যেগুলাে দীর্ঘতর ও প্রশস্ততর। এজন্য বাংলাদেশের কিছু অঞ্চলের সঙ্গে দেশের অন্যান্য অঞ্চল বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার যােগাযােগ ব্যবস্থা তেমন ভালাে নয়। এমনই একটি নদী পদ্মা, যার ওপর সেতু নির্মিত হলে ঢাকাসহ দেশের পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে দক্ষিণ অঞ্চলের ১৯টি জেলার যােগাযােগ নিশ্চিত হবে। বাংলাদেশের জনগণের বহু বছরের, বহু যুগের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতে চলেছে পদ্মাসেতু নির্মাণের মাধ্যমে।
পদ্মা সেতুর ইতিহাসঃ
২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক মেনিফেস্টোর মধ্যে পদ্মা সেতু নির্মাণ ছিল অন্যতম। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু করে। এজন্য বিশ্বব্যাংক, ADB (Asian Development Bank) জাইকা প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান আর্থিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু পদ্মা সেতু নির্মাণে দুর্নীতির অজুহাত তুলে বিশ্বব্যাংক ঋণ দিতে অস্বীকৃতি জানায়। সাথে সাথে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো পদ্মা সেতু নির্মাণে ঋণ প্রদান থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়। এরপর বিভিন্ন তর্ক-বিতর্কের পর আওয়ামীলীগ সভানেত্রী এবং তৎকালীন সরকার প্রধান শেখ হাসিনা মহান জাতীয় সংসদে বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন।
পদ্মা সেতুর বর্ণনাঃ
দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলোমিটার, প্রস্থ ২১.১০ মিটার। মোট পিলার সংখ্যা ৪২টি। ৪০টি নদীর মধ্যে, ২টি সংযোগ সেতুর সাথে। পাইল সংখ্যা ২৬৪টি। নদীর ভেতরের ৪০টি পিলারে ৬টি করে মোট ২৪০টি এবং সেতুর দুই পাশের দুটি পিলারে ১২টি করে মোট ২৪টি পাইল থাকবে। পিলারের ওপর ৪১টি স্প্যান বসানো হচ্ছে।
সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জঃ
বাংলাদেশ সরকার পদ্মাসেতু প্রকল্পটিকে খুবই গুরুত্ব দিচ্ছে। এর পেছনে দুটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, পদ্মাসেতু প্রকল্পের অর্থায়ন নিয়ে বিশ্বব্যাংকসহ দাতাদের সঙ্গে সরকারের তিক্ততার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। তাই সরকার এ প্রকল্পকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে। পাশাপাশি এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বিশ্বের সামনে বাংলাদেশের সক্ষমতাকেও তুলে ধরতে চায় সরকার। দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে ২০০৮ সালে। প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে সরকারের প্রতি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের আস্থা বহুগুণ বেড়ে যাবে। স্বপ্নের পদ্মা সেতু রচনা
পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক গুরুত্বঃ
পদ্মা সেতু নির্মাণ হলে দেশের দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার জনগণের ভাগ্য বদলাবে। সাথে রাজধানী ঢাকার পৌনে দুই কোটি মানুষের খাদ্যদ্রব্যের জোগান সুলভ মূল্যে সম্ভব হবে। দেশের জিডিপি বৃদ্ধি পাবে দ্রুত হারে।
পদ্মাসেতুর মূল কাজের উদ্বোধনঃ
২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাজিরা পাড়ে নদীশাসনের কাজের উদ্বোধন করেন। এরপর মাওয়া পাড়ে সুইচ টিপে পাইলিং কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় মূল সেতুর নির্মাণযজ্ঞ। স্বপ্নের এ সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে। প্রধানমন্ত্রী সুইচ অন করার পর মুহুর্মুহু করতালির আওয়াজের সঙ্গে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী হাইড্রোলিক গ্যামারে নদীর তলদেশে গভীর থেকে গভীরে প্রােথিত হতে থাকে পদ্মাসেতুর মূল পাইল। এর মাধ্যমে বিশ্বকে জানিয়ে দেওয়া হয় নিজস্ব অর্থায়নেই নির্মিত হচ্ছে দেশের বৃহত্তম পদ্মাসেতু। এটি আর স্বপ্ন নয়; বাস্তবদৃশ্য। ৬.১৫ কিলােমিটার দীর্ঘ এই সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হবে ২০১৮ সালের মধ্যেই। সেতুর নির্মাণ কাজের উদ্বোধনী দিনে সাক্ষী হতে ঢল নামে হাজারাে মানুষের। তারা ছুটে আসেন শ্রীনগর, লৌহজং, কেরানীগঞ্জ প্রভৃতি অঞ্চল থেকে। এছাড়া পদ্মার ওপারের জাজিরা এবং মেঘনার ওপারের গজারিয়া থেকেও এসেছেন অনেকে। উপস্থিত জনগণের চোখে-মুখে ছিল স্বপ্ন ।
দারিদ্র্য বিমোচনঃ
১৯৭১ সালে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ছিল প্রায় ৮০ শতাংশ। বর্তমানে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ২৩.২৪ এবং অতি দারিদ্র্যের হার ১২.৯ শতাংশ। সরকারের লক্ষ্য হলো পদ্মা সেতু নির্মাণের মাধ্যমে এবং অন্যান্য প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার। পদ্মা সেতু নির্মাণ হলে ২১টি জেলার সাথে কম খরচে ঢাকায় পণ্য পরিবহন করা যাবে। ফলে ঐসব এলাকায় পণ্যমূল্য আগের তুলনায় বৃদ্ধি পাবে। তখন জনগণ উৎপাদনে উৎসাহ পাবে এবং দ্রুত দারিদ্র্য হ্রাস পাবে।
যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতিঃ
প্রিন্ট মিডিয়া এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় আমরা প্রায়ই দেখতে পাই পাটুরিয়া, দৌলতদিয়া, মাওয়া, জাজিরা ঘাটে শত শত বাস, ট্রাক ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে। কিন্তু পদ্মা সেতু নির্মাণ হলে কম সময়ে কম টাকায় ঢাকার সাথে যোগাযোগ সম্ভব হবে। তাছাড়া পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ হবে, যা যোগাযোগব্যবস্থাকে আরও গতিশীল এবং সহজতর করবে।
কৃষিক্ষেত্রে পদ্মা সেতুর গুরুত্বঃ
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল কৃষিক্ষেত্রে বেশ উন্নত। যেমন : যশোরের ফুল চাষ সারাদেশসহ পাশের দেশগুলোতে বিখ্যাত। বরিশালে প্রচুর ধান উৎপাদন হয়। ফরিদপুর, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জে প্রচুর পাট উৎপাদিত হয়। এসব পণ্য পরিবহনে সময় এবং ব্যয় উভয়ই বেশি হয়। অনেক সময় কৃষিপণ্য পঁচে কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয়। কৃষকরা উৎপাদনে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। কিন্তু পদ্মা সেতু সম্পন্ন হলে কৃষি উৎপাদন দ্রুত বৃদ্ধি পাবে।
শিল্পক্ষেত্রেঃ
পদ্মা সেতু নির্মাণ হলে শিল্পের বেশিরভাগ কাঁচামাল আসবে দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলো থেকে। ফলে ঢাকা এবং চিটাগাংয়ের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো কাঁচামাল সংকটে ভুগবে না। কাঁচামাল সরবরাহ খরচ অনেক গুণ হ্রাস পাবে। দেশের শিল্পপ্রতিষ্ঠান উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে। বর্তমান সরকারের ভিশন ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত দেশে পরিণত হবে।
পদ্মা সেতুর নেতিবাচক প্রভাবঃ
সেতুর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ইতিবাচক দিক থাকলেও এর কিছু নেতিবাচক দিকও আছে। দুই পাড়ের লোকজনের কর্মসংস্থান লোপ পাবে। লঞ্চ, স্টিমার, ফেরিমালিকদের ব্যবসায় মন্দা দেখা দেবে। সেতুর উভয় পাশে নতুন শহর গড়ে উঠবে যাকে কেন্দ্র করে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হতে পারে। ওই এলাকার গরিব মানুষের কর্মসংস্থান লোপ পাবে। পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে। স্বপ্নের পদ্মা সেতু রচনা
পদ্মাসেতু ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাঃ
পদ্মাসেতু এশিয়ান হাইওয়ের পথ হিসেবে ব্যবহৃত হবে। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, পদ্মাসেতু চালু হলে দেশের আর্থিক প্রবৃদ্ধি বাড়বে। পদ্মাসেতু প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়ার পর ঢাকা শহর থেকে মাওয়া মহাসড়ক পর্যন্ত ১৩ কিলােমিটার দীর্ঘ উড়াল সড়ক স্থাপিত হবে। পদ্মাসেতুকে ঘিরে হংকং-এর আদলে নগর গড়ার পরিকল্পনা রয়েছে। মাওয়া থেকে পােস্তগােলা পর্যন্ত চার লেনের সড়ক হবে।
উপসংহারঃ
বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্নের পদ্মাসেতু আজ বাস্তবায়িত হওয়ার পথে। বহু চড়াই-উত্রাই পেরিয়ে অবশেষে ২০১৫ সালে পদ্মসেতুর কাজ শুরু হয়েছে। দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযােগে বিশ্বব্যাংক ও দাতাগােষ্ঠী সরে গেলেও বাংলাদেশ সরকার পিছু হটেনি। সরকার নিজস্ব অর্থায়নে এ সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় আর সে অনুযায়ী কাজও এগিয়ে চলেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কাজের অগ্রগতি তদারকি করছেন, নিয়মিত খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রতি মাসে তিনচার বার করে পদ্মার পাড়ে গিয়েছেন এবং যাচ্ছেন সেতুর কাজ পর্যবেক্ষণ করতে। পদ্মাসেতুর কাজ স্বাভাবিক গতিতেই এগিয়ে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সবাই আশা করছেন, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই সেতু নির্মাণের কাজ শেষ হবে।
স্বপ্নের পদ্মা সেতু রচনা