ড্রাগন ফল উপকারিতা – (Dragon Fruit), যা পিতায়া (Pitaya) নামেও অনেকের কাছে পরিচিত, একটি দেশের বাহিরের ফল যা বর্তমানে বাংলাদেশেও এর জনপ্রিয়তা বেশি। দক্ষিণ আমেরিকার মরুভূমি অঞ্চলের একটি বেশ জনপ্রিয় ফল। একধরনের ফণীমনসা (ক্যাক্টাস) প্রজাতির ফল। এর উজ্জ্বল গোলাপি অথবা হলুদ রঙের খোসা এবং সাদা বা লাল ভেতরের অংশে ছড়ানো সাথে কালো বীজের কারণে এটি দেখতে অত্যন্ত আকর্ষণীয় হয়ে থাকে।
ড্রাগন ফল কত প্রকার – types of dragon fruit
এ ফল প্রধানত তিন প্রকারের হয়:
- সাদা গুঁড়ো মাংস (White-Fleshed Pitaya): এর বাইরের খোসাটা দেখতে গোলাপি এবং ভেতরের অংশ সাদা হয়ে থাকে। এটি সবচেয়ে বেশি চাষ হয়ে থাকে।
- লাল গুঁড়ো মাংস (Red-Fleshed Pitaya): এর খোসা দেখতে গোলাপি এবং ভেতরের দেখতে অংশ লাল। এর স্বাদ আরও অনেক মিষ্টি।
- হলুদ ড্রাগন ফল (Yellow Pitaya): এর খোসা হলুদ এবং ভেতরের অংশ সাদা হয়ে থাকে। এটি সবচেয়ে মিষ্টি স্বাদের হয়।
Dragon fruit nutrition – ড্রাগন ফলের পুষ্টিগুণ
ড্রাগন ফল নানান ধরনের পুষ্টিগুণে ভরপুর, যা শরীরের জন্য আমাদের বেশ উপকারী। এতে রয়েছে ভিটামিন, খনিজ, এবং বিভিন্ন প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান।
পুষ্টি উপাদান (১০০ গ্রাম ড্রাগন ফলে) থাকে:
- ক্যালোরি: ৫০
- প্রোটিন: ১g গ্রাম
- ফাইবার: ৩g গ্রাম
- ভিটামিন সি: দৈনিক প্রয়োজনীয়তার ৩৪% থাকে
- আয়রন: ১০% থাকে
- ম্যাগনেসিয়াম: ১৮% থাকে
- অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট: উচ্চমাত্রায় বিদ্যমান থাকে।
এই ড্রাগন ফল কোলেস্টেরল মুক্ত এবং এতে প্রাকৃতিক চিনির মাত্রা কম, যা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য একদম নিরাপদ।
ড্রাগন ফল উপকারিতা – health benefit of dragon fruit
Dragon Fruit ( ড্রাগন ফল উপকারিতা ) – শুধু দেখতে আকর্ষণীয় নয়, এটি শরীরের জন্যও আমাদের বেশ উপকারী। এর স্বাস্থ্যগত উপকারিতা নিচে দেওয়া হলো:
১. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করবে:
ড্রাগন ফলে থাকা ভিটামিন সি এবং অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকার কারণে এটি আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার পরিমাণ বাড়ায়। এটি শরীরের ক্ষতিকর ফ্রি র্যাডিক্যাল দূর করতে সহায়তা করে।
২. হৃদরোগ প্রতিরোধ করে:
এটি আমাদের খারাপ কোলেস্টেরল (LDL) কমিয়ে এবং ভালো কোলেস্টেরল (HDL) পরিমান বাড়িয়ে হৃদযন্ত্রকে সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করে। এতে থাকা ফ্যাটি অ্যাসিড আমাদের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে থাকে।
৩. ওজন কমাতে সাহায্য করে:
এই ফলে ক্যালোরির পরিমানটা অনেক কম এবং ফাইবারের পরিমান বেশি থাকে। যার ফলে এটি দীর্ঘ সময় ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণে আমাদের সাহায্য করে এবং ওজন কমাতে বেশ কার্যকর।
৪. ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে:
ড্রাগন ফলে থাকা গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম হওয়ার কারনে এটি রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে থাকে।
৫. হজম শক্তি বৃদ্ধি করে:
এই ফলে উচ্চ ফাইবার থাকার কারনে হজম প্রক্রিয়াকে উন্নত করে এবং অন্ত্রের কার্যক্রম সঠিক রাখতে সাহায্য করে।
৬. ত্বক ও চুলের যত্ন বেশ উকার:
ড্রাগন ফলে থাকা অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং ভিটামিন আমাদের ত্বকের বলিরেখা গুলো দূর করতে এবং উজ্জ্বলতা বাড়াতে সাহায্য করে থাকে। এটি আমাদের চুলের গঠন মজবুত করে থাকে।
৭. ক্যানসার প্রতিরোধ করে:
ড্রাগন ফলে থাকা বিটা-ক্যারোটিন এবং লাইকোপিন আমাদের ক্যানসার প্রতিরোধে সহায়তা করে।
৮. হাড়ের শক্তির পরিমান বাড়ায়:
এতে উপস্থিত থাকা ক্যালসিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়াম হাড়ের শক্তি বাড়ায়, যার ফলে হাড় সহজে ভেঙে যায়না বা ক্ষয় হয়না এবং অস্টিওপোরোসিসের ঝুঁকি কমায়।
ড্রাগন ফলের অপকারিতা – Dragon fruit side effects
Dragon – ড্রাগন ফল উপকারিতা হলেও এর বেশ কিছু অপকারিতা আছে, সেজন্য এটি খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হতে পারে।
- অতিরিক্ত পরিমান ড্রাগন ফল খেলে আপনার ডায়রিয়া হতে পারে।
- অনেকে বিভিন্ন ফলে এলার্জি থাকে। তাদের যদি এ ফলের প্রতি অ্যালার্জি থাকে, তাদের এটি খাওয়া উচিত না।
- যদিও রক্তে শর্করা কমানোর জন্য ড্রাগন ফল বেশ কার্যকর হলেও এটি অতিরিক্ত খেলে শর্করার মাত্রা খুব কমিয়ে দিতে পারে।
- এটি অতিরিক্ত ফাইবার থাকে। যার কারনে অনেকের হজমের সমস্যা হতে পারে। যার ফলে গ্যা,পেট ফাপা এমনকি ডায়ারিয়াও হতে পারে।
ড্রাগন ফল খাওয়ার নিয়ম
এ ফল সাধারণত তাজা খাওয়া হয়। এটিকে স্লাইস করে খেতে পারেন বা স্মুদি, সালাদ কিংবা ডেজার্ট হিসেবেও ব্যবহার করতে পারেন। অনেকেই এটি শরবত বা অন্যান্য ড্রিংকে যোগ করে খেতে পছন্দ করেন। তবে অতিরিক্ত না খেয়ে পরিমিত পরিমাণে খেলে এটি সর্বোচ্চ উপকার করবে।
এটি খাওয়ার নিয়ম বেশ সহজ এবং স্বাস্থ্যকর। প্রথমে একটি পরিপক্ব ড্রাগন ফল বেচে নিন, যা উজ্জ্বল লাল বা হলুদ রঙের এবং সামান্য নরম হতে হবে। এবার এটি ভালোভাবে ধুয়ে পরিষ্কার করে নিন। এরপর ধারালো ছুরি দিয়ে ফলটিকে মাঝখান থেকে কেটে দুই ভাগ করুন। ভেতরের সাদা বা লাল গুদা ও ছোট ছোট কালো বীজ খাওয়ার জন্য এবার প্রস্তুত। আপনি চামচ দিয়ে গুদা তুলে সরাসরি খেতে পারেন, অথবা এটি ছোট টুকরো করে কেটে সালাদ বা অন্যান্য খাবারে সাথে মিশিয়ে নিতে পারেন।
এ ফল স্মুদি বা জুসের জন্যও দারুণ উপযুক্ত। ফলের গুদা ব্লেন্ডারে দিয়ে সামান্য পানি, মধু বা দুধ মিশিয়ে স্মুদি তৈরি করুন। এটি খাওয়ার সেরা সময় হলো সকালে নাস্তার সময় বা মধ্যাহ্নভোজের পর, কারণ এটি শক্তি জোগায় এবং হজমে সাহায্য করে। রাতে ঘুমানোর আগে খেলে এটি শরীর শীতল রাখতে সাহায্য করে এবং ভালো ঘুমে আসতে সাহায্য করে।
ড্রাগন ফল খাওয়ার সময় অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে যেন অতিরিক্ত না খাওয়া হয়। কারণ এটি ডায়রিয়ার কারণও হতে পারে। যাদের ড্রাগন ফলে অ্যালার্জি রয়েছে, তারা এটিকে এড়িয়ে চলবেন। উপযুক্ত নিয়ম মেনে ড্রাগন ফল খেলে এটি শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী, কারণ এটি হজম শক্তি বাড়াবে, ওজন কমাবে এবং ইমিউন সিস্টেমকে অনেক শক্তিশালী করে।
লেবু আমাদের কি কি শরীরের উপকার করে জানেন আপনি? বিস্তারিত জানতে হলে লেবু পানির উপকারিতা ও অপকারিতা পড়ুন!
ড্রাগন ফলের খোসার উপকারিতা – dragon fruit eating benefits
এ ফলের খোসা সাধারণত ফেলে দেই আমরা, তবে এতে রয়েছে প্রচুর পুষ্টিগুণ এবং উপকারী উপাদান যা অনেক ক্ষেত্রে উপকার বয়ে আনতে পারে। নিচে ড্রাগন ফলের খোসার কিছু উপকারিতাগুলো উল্লেখ করা হলো:
ত্বকের যত্নে সাহায্য করে
এর খোসায় থাকা অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং ভিটামিন-ই ত্বকের জন্য আমাদের বেশ উপকারী। এটি ত্বকের:
- আর্দ্রতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।
- বলিরেখা/দাগের পরিমান কমায়।
- স্কিন/ত্বক উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে।
- খোসা যদি পেস্ট করে মুখে লাগালে আমাদের ত্বকের টোন উন্নত হয়।
চুলের যত্নে ব্যবহার করলে
এ ফলের খোসার নির্যাস থেকে চুলের গোঁড়া বেশ মজবুত করে থাকে। এমনকি খুশকি কমাতে সাহায্য করে এই ফল । এটি চুলের বৃদ্ধি বাড়াতে এবং ক্ষয় রোধ করতেও সাহায্য করে।
ওজন কমাতে সাহায্য করে
এ ফলের খোসায় ফাইবার থাকে, যা আমাদের হজম প্রক্রিয়া উন্নত করে এবং ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। ফলে এটি ওজন কমাতে সাহায্য করে।
ড্রাগন ফল চাষ পদ্ধতি / গাইডলাইন – dragon tree fruit
চাষ পদ্ধতি দেখবো আমরা। প্রত্যেকটি তথ্য ভালোভাবে পড়বেন। আশা করি আপনি চাষ পদ্ধতি ভালো ভাবে শিখতে পারবেন।-
ড্রাগন ফল চাষের বিশেষ ধরনের সুবিধা
- গরম আবহাওয়ায় এটা অনেক ভালো জন্মে।
- যত্ন আমাদের কম লাগে।
- একবার যদি চারা রোপণ করি তাহলে ২০-২৫ বছর ফল পাওয়া যায়।
- আন্তর্জাতিক সহ দেশের বাজারে চাহিদা অনেক বেশি।
- রাসায়নিক সার এতে কম প্রয়োজন হয়।
ড্রাগন ফলের জাত
চাষ জানার পূবে আপনাকে এর জাত সম্পর্কে জানতে হবে। ড্রাগন ফলের প্রধানত তিনটি জাত রয়েছে:
- লাল খোসা ও সাদা গুদা: এটা সবচেয়ে বেশি চাষ হয়।
- লাল খোসা ও লাল গুদা: বেশি মিষ্টি এবং দামও বেশি।
- হলুদ খোসা ও সাদা গুদা: এটি তুলনামূলক কম চলে।
আপনার এলাকার আবহাওয়ার জন্য উপযুক্ত জাত দেখে বুঝে বেছে নিন।
চাষের জন্য প্রয়োজনীয় শর্তাবলী হলো-
১. আবহাওয়া ও মাটি
- গরম এবং আর্দ্র পরিবেশে এর চাষ উপযুক্ত বলে ধরা হয়।
- ২০°C থেকে ৩৫°C তাপমাত্রায় এটি অনেক ভালো ফলন দেয়।
- মাটি বেলে-দোআঁশ বা দোআঁশ হলে সবচেয়ে ভালো হয়।
- মাটির pH মান: ৫.৫ থেকে ৭.৫ হতে হবে।
২. এবার জমি তৈরি
- জমি ঝোঁপঝাড়মুক্ত করতে হবে। আশে পাশে সব পরিস্কার করে নিন।
- প্রতি গর্তে কম্পোস্ট সার বা গোবর সার মিশিয়ে নিন।
- মাটি যেনো পানি জমে না থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখুন।
এবার চারা রোপণ পদ্ধতি বলা যাক-
- গর্ত তৈরি করুন:
- প্রতি গর্তের পরিমান হবে ৫০ × ৫০ × ৫০ সেমি রাখুন।
- গর্তের মাঝে পিলার বা শক্ত কিছু বসান। পিলার আপনাকে শক্তিশালী বানাতে হবে, কারণ গাছ পিলারের ওপর ভর করেই বড় হবে।
- চারা রোপণ পদ্ধতি:
- কাটিং বা শাখা থেকে তৈরি করা চারা রোপণ করুন।
- প্রতি পিলারের চারপাশে ৩-৪টি করে চারা লাগান। বেশি লাগাবেন না।
- দূরত্ব:
- প্রতিটি গাছ থেকে গাছের দূরত্ব: ১.৫-২ মিটার হতে হবে।
- সারি থেকে সারির দূরত্ব: ২-৩ মিটার হতে হবে।
পরিচর্যা পদ্ধতি দেখুন-
১. সেচ দিতে হবে-
- গাছ রোপণের পর হালকা পানি দিন বেশি দিবেন না।
- গ্রীষ্মকালে এতে ৭-১০ দিন অন্তর সেচ দিন।
- বর্ষাকালে কখনো এতে পানি জমতে দেবেন না।
২. সার প্রয়োগ- কখন কখন দিবেন
- প্রতি বছর ২-৩ বার জৈব সার অথ্যাৎ তিন বা চার মাস পর এবং এনপিকে (NPK) সার দিন।
- ফল আসার আগে এবং পরে গাছে জৈব সার দিতে হবে।
৩. গাছ ছাঁটাই কখন করবেন-
- অতিরিক্ত যে শাখা হয় সেগুলো কেটে ফেলুন যাতে আলো-বাতাস চলাচল ভালো হয়।
- ছাঁটাই করা শাখা থেকে আবার নতুন চারা তৈরি করা যায়।
৪. পোকামাকড় দমন করবেন-
- প্রয়োজন হলে জৈব কীটনাশক এতে ব্যবহার করুন।
- ফাংগাল ইনফেকশন প্রতিরোধে গাছের নিচে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখুন।
ফল ধরার সময় ও সংগ্রহ করা-
- গাছ রোপণের ১২-১৮ মাস পর প্রথম ফল আসা শুরু করবে।
- ফুল ফোটার ৩০-৩৫ দিন পর এর ফল পাকে।
- এক গাছ থেকে আপনি বছরে ৪-৬ বার ফল পাবেন।
- প্রতি গাছে গড়ে ১০-১৫ কেজি ফল এতে ধরে।
কলা খেলে কি উপকার পাবেন জানেন কি? বিস্তারিত জানতে হলে পাকা কলার উপকারিতা ও অপকারিতা পোষ্টটি পড়ুন!
বাজারজাতকরণ
- এটা স্থানীয় বাজারে ও সুপারশপে খুব সহজে বিক্রি করতে পারেন।
- আন্তর্জাতিক বাজারেও এটাতে রপ্তানির সুযোগ রয়েছে।
- এক কেজি পরিমান ড্রাগন ফলের দাম ২০০-৬০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে।
লাভজনকতার হিসাব
- প্রাথমিক খরচ: জমি, পিলার, চারা, সার এবং সেচ হিসাব করবেন।
- প্রতি গাছে আয়: এক বছরে ১৫-২০ কেজি ফল ধরে।
- লাভ: গড়ে এতে ৫০০% পর্যন্ত মুনাফা সম্ভব।
ড্রাগন ফল কেন খাবেন জানতে হলে ড্রাগন সম্পর্কে অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ পড়ুন!